১. বহুবচনের দ্বিত্বজনিত ভুল : অনেক সময়েই দেখা যায়, ভাষা ব্যবহারকারী অশুদ্ধভাবে বহুবচনের দ্বিত্ব ব্যবহার করে থাকেন। এ প্রবণতা এত ব্যাপক যে, কোন লেখক এ ত্রুটি থেকে মুক্ত তা খুঁজে বের করাও প্রায় দুরূহ হয়ে ওঠে। 'সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশগুলো', 'সব প্রকাশ মাধ্যমগুলো', 'নিম্নলিখিত সব শিক্ষার্থীগণ', 'সব উপদেষ্টামণ্ডলী', 'কতিপয় সিদ্ধান্তবলি', 'দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলাসমূহে'- এমন ধরনের বহুবচনের দ্বিত্বজনিত অপপ্রয়োগ অহরহ চোখে পড়ে। সামান্য সতর্কতাই এ ত্রুটি থেকে লেখককে মুক্তি দিতে পারে। উপরের দৃষ্টান্তগুলোর শুদ্ধ প্রয়োগ হবে- 'সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশ', অথবা 'সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলো', 'প্রকাশ মাধ্যমগুলো' অথবা 'সব প্রকাশ মাধ্যম', 'নিম্নলিখিত সব শিক্ষার্থী' অথবা 'নিম্নলিখিত শিক্ষার্থীগণ', 'সব উপদেষ্টা' অথবা 'উপদেষ্টামণ্ডলী', 'কতিপয় সিদ্ধান্ত', 'দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলায়' অথবা 'দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে' ইত্যাদি। এমন একটি অপপ্রয়োগের উদাহরণ 'কর্তৃপক্ষগণ'। কেননা, কর্তৃপক্ষ শব্দটি বহুবচন বাচক। 'কর্তৃপক্ষ' শব্দের অর্থ শাসকগণ, পরিচালকগণ, নিয়ন্ত্রকগণ ইত্যাদি। অতএব, কর্তৃপক্ষ শব্দের শেষে 'গণ' প্রয়োগ বাহুল্য ও অশুদ্ধ।
২. ইং, তাং, নং, চৌং ইত্যাদি : অধিকাংশ বাঙালি তারিখের পর 'ইং' বলে একটা 'চিহ্ন' লিখে থাকে। তারিখ, নম্বর, চৌধুরী_ এসব শব্দকেও লেখা হয় তাং, নং, চৌং রূপে। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কবে এ প্রবণতার সূত্রপাত তা আমাদের জানা নেই। তবে এসব চলছে দীর্ঘদিন ধরে- শিক্ষিত, শিক্ষার আলোকবঞ্চিত নির্বিশেষে। কিন্তু কেন এমন হলো? তারিখ, নম্বর, চৌধুরীর পরিবর্তে যদি সংক্ষিপ্তরূপে লেখা হতো তা. ন. চৌ. তাহলেও মানা যেত। কিন্তু সংক্ষেপে চিহ্নের পরিবর্তে কেন অনুস্বর (ং) বর্ণ? মনে রাখতে হবে সংক্ষেপে চিহ্ন (.) একটা বিরাম চিহ্ন, পক্ষান্তরে অনুস্বর (ং) হচ্ছে একটা বর্ণ। একটা বর্ণ দিয়ে একটা বিরাম চিহ্নের কাজ চালাতে গিয়েই ঘটেছে দৃষ্টিকটু অপপ্রয়োগ। তারিখ লেখার পর 'ইং' লেখা অনেকটা জাতীয় মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। 'ইং' কি ইংরেজির সংক্ষিপ্ত রূপ? এক্ষেত্রে এক ধরনের অপপ্রয়োগ ঘটল- সংক্ষিপ্ত চিহ্নের (.) স্থলে বসানো হলো একটি বর্ণ (ং)। অন্যটি কী? পৃথিবীতে ইংরেজি সাল বলে তো কোনো সাল নেই। তাই 'ইং'-এর প্রশ্নই আসে না। খ্রিস্টীয় সালকে কে ইংরেজি সাল বলে চালিয়ে দিল? প্রথমে যে-ই চালু করুক না কেন, এ ক্ষেত্রে তার 'সাফল্য' বিস্ময়কর। একটা অপপ্রয়োগের ব্যাধিতে গোটা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীই আক্রান্ত। এমনকি পহেলা জানুয়ারিতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ঘোষক-ঘোষিকা, সংবাদ-পাঠকের মুখে শোনা যায় 'ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা' জানানোর কথা, পর্দায়ও ভেসে ওঠে অভিন্ন শুভেচ্ছা, জাতীয় দৈনিকের পাতায়ও জানানো হয় একই রকম অপপ্রয়োগজাত শুভেচ্ছা।
৩. প্রেক্ষিত : পরিপ্রেক্ষিত অর্থে বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় 'প্রেক্ষিত' শব্দটি। লেখাই বাহুল্য যে, এটা ভুল প্রয়োগ। 'প্রেক্ষিত' শব্দ এসেছে 'প্রেক্ষণ' থেকে। 'প্রেক্ষণ' বিশেষ্য পদ, যার অর্থ দৃষ্টি। এ থেকে তৈরি হয়েছে বিশেষণ পদ 'প্রেক্ষিত' (উচ্চারণ 'প্রেকখিতো') যার অর্থ দর্শিত বা যা দেখা হয়েছে। অর্থাৎ 'প্রেক্ষিত' শব্দের সঙ্গে দৃষ্টি/দেখা/দর্শিত এসব অর্থ জড়িত আছে। কিন্তু এই অর্থকে পাল্টে দিয়ে অধিকাংশ লেখক 'প্রেক্ষিত' শব্দ ব্যবহার করেন পটভূমি/পরিপ্রেক্ষিত/ Perspective/background অর্থে। এই ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ. ডি পর্যায়ের অভিসন্দর্ভের শিরোনামাতেও কখনো কখনো লক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে সকলের সতর্কতা জরুরি।
৪. জন্মজয়ন্তী : 'জন্মজয়ন্তী' শব্দের ব্যবহারও এত বেশি যে একটি অপপ্রয়োগই শুদ্ধ প্রয়োগ বলে মনে হতে পারে। 'জয়ন্তী' শব্দের মাঝেই আছে জন্ম-প্রসঙ্গ; কাজেই জয়ন্তীর পূর্বে 'জন্ম' শব্দের প্রয়োজন পড়ে না। 'জয়ন্তী' শব্দের অর্থ জন্মোৎসব, কোনো ব্যক্তির জন্মতিথি উপলক্ষে উৎসব। গ্রাম থেকে শহরে আসা শিক্ষার আলোকবঞ্চিত কোনো কৃষক যদি হাসপাতালে তার আত্দীয়কে দেখে এসে বলেন, 'হাসপাতালে গিয়েছিলাম, আসার সময় রোগীকে ফলফ্রুট দিয়ে এলাম'- এক্ষেত্রে 'ফলফ্রুটে'র ক্ষেত্রে যেমন অপপ্রয়োগ ঘটে, তেমনি অপপ্রয়োগ হয় 'জন্মজয়ন্তী'র ক্ষেত্রেও। অতএব, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মজয়ন্তী না বলে বলা উচিত 'রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জয়ন্তী'।
৫. অত্র-তত্র-যত্র : 'অত্র' শব্দের অর্থ এখানে, 'তত্র' সেখানে, 'যত্র' যেখানে, 'যত্র-তত্র' যেখানে-সেখানে। 'অত্র' কখনোই 'এই' অর্থে ব্যবহার শুদ্ধ প্রয়োগ হতে পারে না। কিন্তু 'অত্র অফিস', 'অত্র বিশ্ববিদ্যালয়', 'অত্র স্থান'- এমন ব্যবহার প্রায়শই চোখে পড়ে। শুদ্ধ প্রয়োগ হবে- এই অফিস, এই বিশ্ববিদ্যালয়, এই স্থান প্রভৃতি। কাজেই 'এই' অর্থে 'অত্র' যত্রতত্র যাতে ব্যবহার না করা হয়, সেদিকে ভাষা-ব্যবহারকারীকে সতর্ক থাকতে হবে।
Popular Posts
-
প্রশ্ন: আধুনিক বাংলা ভাষার পরিধি কত সাল থেকে শুরু হয়েছে ? উঃ ১৮০১ সাল থেকে। (প্রস্তুতিপর্বঃ ১৮০০-১৮৬০, বিকাশপর্বঃ ১৮৬০-১৯০০, রবীন্দ্রপর্বঃ...
-
ফাল্গুন চলে এল বলে। বাইরে ঘোরাঘুরির কত পরিকল্পনা করা হচ্ছে। অথচ কী একটা ব্রণ উঠে আছে কপালে। ত্বক দেখাচ্ছে রুক্ষ। এভাবে কি বাইরে যাওয়া যায়?...
-
ঝগড়া চালিয়ে যাওয়া: অতীতের ভুল বা ঝগড়ার বিষয় গোলাবারুদের মতো ব্যবহার করা এবং সেগুলো মনের মধ্যে পুষে রাখা নানান কারণে ক্ষতিকর। চালিয়ে যাওয়া ঝ...
-
বিসিএস রিটেনে Summary ২০ নম্বরের। কিভাবে Summary লিখতে হবে তা অনেকেই জানেনা।ভালভাবে Summary লিখতে না জানলে ভাল নম্বর পাওয়া যাবেনা। এবার ...
-
যারা বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা দিবেন তারা হয়তও অনেকেই জানেননা লিখিত পরীক্ষার মানবণ্টন।অর্থাৎ পাটিগণিত থেকে কত আসবে কিংবা বীজগণিত বা জ্যামিতি ব...
-
ভর্তার রেসিপি : ০১। আলু ভর্তা: আলু আধা কেজি সিদ্ধ করে চটকে নিন। এবার পাত্রে ২ টেবিল চামচ তেল দিয়ে শুকনা মরিচ ভেজে পেঁয়াজ কুঁচি দিন। পেঁ...
No comments:
Write comments